সংগৃহীত এবং সংকলিত: মুহম্মাদ হোসায়েন (বাংলাদেশ)
পর্ব ২- প্রথমত - মহানবী (সাঃ) অনিবার্য কোন কারণ যেমন , সফর , বৃষ্টি এবং শত্রুর ভয়-ভীতির কোন আশংকা ছাড়াই দুটি নামাজ (যোহর-আসরের এবং মাগরিব-এশার নামাজ) একত্রে আদায় করেছেন ।
দ্বিতীয়ত - তাঁর এ কাজের উদ্দেশ্য ছিল উম্মতের কষ্ট লাঘব এবং প্রশস্ত সুযোগ রাখা । এমতাবস্থায় এটা কি আদৌ সমীচীন যে , একশ্রেণীর লোকেরা এ ক্ষেত্রে নানাবিধ অন্তরায় সৃষ্টি করবে এবং এটা প্রচার করবে যে , শুধুমাত্র অনিবার্য কারণবশতঃ দুটি নামায একত্রে আদায় করা যাবে !
কেন আমরা বাস্তবতা হতে চোখ ফিরিয়ে নিব এবং রাসুলের (সাঃ) সুস্পষ্ট সুন্নতের পরিপন্থী আকিদার উপর গুরুত্বারোপ করব ? স্বয়ং আল্লাহ ও রাসুল (সাঃ) যে সুযোগ মানুষকে দিয়েছেন , কেন একশ্রেণীর ব্যক্তির গোঁড়ামি মানসিকতার অন্য ব্যক্তিরা সে সুযোগের যথোচিত ব্যবহারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে ?
তারা কেন চায় না মুসলিম যুবকরা সর্বত্র ও সর্বাবস্থায় দেশের অভ্যন্তরে ও বাইরে , বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে , অফিস-আদালতে এবং কল-কারখানায় শরীয়তের প্রদত্ত সুবিধাজনক পন্থায় প্রতিদিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমল তথা দৈনন্দিন নামায আদায় করুক ?
আমরা বিশ্বাস করি যে , পবিত্র ইসলাম ধর্মেও বিধি-বিধান কেয়ামত অবধি বিশ্বের সর্বত্র ও সর্বকালের জন্য বহাল রয়েছে ।
নিঃসন্দেহে মহানবী (সাঃ) তাঁর নজিরবিহীন দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর আজীবন অবস্থাকে পর্যবেক্ষণ করেছেন । আর তাই তো তিনি এটা ভালভাবে বুঝতে পেরেছিলেন যে , সবাইকে যদি দৈনন্দিন পাঁচ ওয়াক্ত পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে নামাজ আদায় বাধ্য করা হয় , তাহলে একদল মুসলমান নামাজ পরিত্যাগ করবে , যেমনটি বর্তমানে ঘটেছে । এ কারণেই তিনি স্বীয় উম্মতের প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করেছেন এবং মোক্ষম সুযোগের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন , যাতে মুসলমানরা যে যেখানেই ব্যস্ত থাকুক না কেন দৈনন্দিন নামাজসমূহ যেন সহজেই আদায় করতে পারে ।
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে ,
" -- ধর্মের ব্যাপারে তোমাদের উপর কোন সংকীর্ণতা রাখা হয় নাই -- ।”
সূত্র - সুরা হজ্ব / ৭৮ ।
২...পবিত্র কোরআন এবং নামাজের তিনটি বিশেষ সময় ।
আশ্চর্যকর বিষয় হচ্ছে পবিত্র কোরআনের দুটি আয়াতে নামাজের সময়সূচীর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে । সেখানে দিবারাত্রের নামাজসমূহের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র তিনটি বিশেষ সময়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে ।
তথাপি সুন্নি মাযহাবের ভাইয়েরা কেন দৈনন্দিন নামাজসমূহ পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আদায় করাকে ওয়াজীব মনে করেন , তা আমাদের মোটেও বোধগম্য নয় । অবশ্য এ নামাজসমূহ পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আদায় করা মুস্তাহাব ও উত্তম হওয়ার বিষয়টি অনস্বীকার্য । আমরাও যদি সময় ও সুযোগ অনুকূলে থাকে তবে পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আদায় করার চেষ্টা করি । কিন্ত আমাদের আপত্তি হচ্ছে এটাকে "ওয়াজীব" মনে করার ক্ষেত্রে ।
নামাজের সময়সূচী সম্পর্কে বর্ণিত প্রথম আয়াতটি সূরা হুদের অন্তর্ভুক্ত এখানে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে ,
“ -- আর নামায আদায় করবে দিনের দুই প্রান্তে এবং রাত্রের প্রান্তভাগে -- ।”
সূত্র - সুরা - হুদ / ১১৪ ।
এখানে طرف النهار দিনের দু’প্রান্তে বলতে ফজরের সময় যে সময়টি হচ্ছে দিনের সূচনালগ্ন এবং যোহর ও আসরের সময়কে যা দ্বিপ্রহর থেকে শুরু করে সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত বুঝানো হয়েছে ।
অন্যভাবে বলা যায় যে , এ আয়াতের মাধ্যমে যোহর ও আসরের নামাজের সময়সীমা সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত বহাল থাকার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায় ।
পাশাপাশি উক্ত আয়াতে زلفا من اللیل শব্দাবলীর মধ্যে زلف হচ্ছে زلفه এর বহুবচন । বিশিষ্ট আভিধানিক রাগেব ইসফাহানী বলেছেন যে , এ শব্দটির অর্থ হচ্ছে রাত্রের প্রথমাংশ , যা মাগরিব ও এশার নামাজের সময়ের প্রতি ইঙ্গিত বহন করে ।
সুতরাং রাসুল (সাঃ) বেশীরভাগই দৈনন্দিন পাঁচটি সময়ে নামায আদায় করেছেন এ কারণে যে , তা হচ্ছে মুস্তাহাব ও উত্তম । যে বিষয়টি আমরা ঐকমত্যের ভিত্তিতে বিশ্বাস করি ।
কিন্ত তাইবলে পবিত্র কোরআনের বাহ্যিক ঘোষণাকে উপেক্ষা করে অন্যরূপ ব্যাখ্যার পেছনে ছোটার কোন প্রয়োজন নাই ।
অপর আয়াতটি পবিত্র কোরআনের সূরা বনী ইসরাইল বর্ণিত হয়েছে -
“ --- অপরাহ্ন বা সূর্য ঢলে পড়ার সময় থেকে রাতের অন্ধকার পর্যন্ত নামাজ কায়েম কর এবং ফজরের কোরআন পাঠও (ফজরের নামাজও কায়েম কর)। নিশ্চয়ই ফজরের কোরআন পাঠ মুখোমুখী হয় ---।”
সুরা - বনী ইসরাইল / ৭৮ ।
এ আয়াতে دلوک শব্দের অর্থ হচ্ছে ঢলে পড়া এখানে সূর্য মধ্যাহ্ন হতে অপরাহ্নের দিকে ঢলে পড়ার সময়ের প্রতি ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে ।
غسق اللیل শব্দের অর্থ হচ্ছে রাত্রের অন্ধকারাচ্ছন্ন ।
কেউ কেউ এ শব্দের ব্যাখ্যায় রাতের প্রথমাংশ আবার কেউ কেউ রাতের মধ্যাংশকে বুঝিয়েছেন । রাগেব ইসফাহানী তার ‘মুফরাদাত’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, غسق শব্দের অর্থ হচ্ছে রাতের অন্ধকারাছন্ন , যা সাধারণত মধ্যরাতকেই বুঝানো হয় ।
সুতরাং دلوک الشمس বা সূর্য ঢলে পড়ার সময়কে যোহর ও আসর নামাজের সূচনালগ্ন,غسق اللیل বা মধ্যরাত্রের সময় হচ্ছে মাগরিব ও এশার নামাজের সামাপ্তি কাল এবং قران الفجر বলতে ফজর নামাজের সময়কে বুঝানো হয়েছে ।
যাইহোক , পবিত্র কোরআনে দৈনন্দিন ওয়াজীব নামাজের ক্ষেত্রে মাত্র তিনটি বিশেষ সময়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে , না পাঁচটি । আর এ বিষয়টি তিনটি বিশেষ সময় বা ওয়াক্তে নামাজ সহীহ হওয়ার ক্ষেত্রে সুদৃঢ় দলীল হিসেবে প্রমাণিত ।
বিশিষ্ট সুন্নী মুফাসসির ফাখরুদ্দীন রাজী স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে উপরোক্ত আয়াতের তাফসীরে অত্যন্ত চমকপ্রদ বর্ণনা তুলে ধরেছেন , গাসাকা (غسق) শব্দের অর্থ হচ্ছে রাতের প্রথমাংশে আধারের আগমণ (ইবনে আব্বাস, আতা এবং নাসর বিন সুমাঈল এ মতের পক্ষে রায় দিয়েছেন) । তাহলে এটা হবে মাগরিবের বা সূর্যাস্তের প্রথম সময় । সুতরাং আয়াতে দৈনন্দিন নামাজের ক্ষেত্রে তিনটি সময়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে । যথা , জাওয়াল বা দ্বি-প্রহরের সময় , মাগরিবের প্রথম সময় এবং ফজরের সময় ।
অতঃপর তিনি উল্লেখ করেছেন , এটা থেকে বুঝা যায় যে , জাওয়াল হচ্ছে যোহর ও আসর নামাজের সময় । অর্থাৎ এটা এ দুটি নামাজের জন্য যৌথ সময় হিসেবে গণ্য । আর সূর্যাস্তের প্রথম সময় মাগরিব ও এশার নামাজের যৌথ সময় হিসেবে বিবেচিত । সুতরাং উক্ত নামাজদ্বয়ের যৌথ সময় রয়েছে । যার ফলাফল হবে যোহর-আসর এবং মাগরিব এশার নামাজ একত্রে আদায় করা সম্পূর্ণ জায়েয এবং বৈধ ।
সূত্র - তাফসীরে কাবীর , ২১তম খন্ড, পৃ. ২৭ ।
যদিও ফাখরুদ্দীন রাজী এ পর্যন্ত উক্ত আয়াতের যথারীতি তাফসীর করেছেন । কিন্ত উপসংহারে এসে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, যেহেতু অনিবার্য কোন কারণ ব্যতীত উক্ত নামাজদ্বয় একত্রে পড়া জায়েয নয় , সেহেতু এ আয়াত শুধুমাত্র উক্ত অনিবার্য কারণসমূহের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে ।
সূত্র - তাফসীরে কাবীর, ২১তম খন্ড , পৃ. ২৭ ।
আমরা এখানে তার জ্ঞাতার্থে বলতে চাই যে , অত্র আয়াতে বিশেষ কোন কারণের কথা উল্লেখ করা তো দূরের কথা । বরং খোদ সুন্নি মাযহাবের নির্ভরযোগ্য হাদিস গ্রন্থে অনেক রেওয়ায়েতে (যা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে) বর্ণিত হয়েছে যে , রাসুলুল্লাহ (সাঃ) অনেক সময় কোন বিশেষ কারণ যেমন , সফর কিংবা কোন অনিষ্টের আশংকা ছাড়াই যোহর-আসর এবং মাগরিব-এশার নামাজ একত্রে আদায় করেছেন । যাতে তা মুসলমানদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে এবং তারাও যেন এ সুযোগ ব্যবহার করতে পারে । এছাড়া উক্ত আয়াতের ঘোষিত তিনটি সময়কে অনিবার্য কিছু কারণের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা মোটেও নিয়মসিদ্ধ ও যুক্তিসঙ্গত নয় ।
সুতরাং , পবিত্র কোরআনের উক্ত আয়াতদ্বয়ে দৈনন্দিন নামাজের জন্য যে তিনটি বিশেষ সময়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা অস্বীকার করা কোনভাবেই সম্ভব না ।
সম্মানীয় পাঠক ,
এ অধ্যায়ের আলোচিত বিষয়াবলী হতে আমরা নিম্নের সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারিঃ
১) - পবিত্র কোরআনে দৈনন্দিন পাঁচটি নামাজের ক্ষেত্রে তিনটি বিশেষ সময়ের কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে ।
২) - শীয়া ও সুন্নি উভয় মাযহাবের প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে , রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বহুবার বিশেষ কোন কারণ যেমন , সফর কিংবা কোন অনিষ্টের আশংকা ছাড়াই দুটি নামাজ একত্রে আদায় করেছেন । আর এ সুন্নতকে তিনি তাঁর উম্মতের জন্য বিশেষ সুযোগ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন , যাতে তারা কোনরূপ বাড়তি চাপের সম্মুখীন না হয় ।
৩) - নিঃসন্দেহে দৈনন্দিন পাঁচটি নামাজ ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আদায় করা মুস্তাহাব । কিন্ত যে কোন মূল্যে এ মুস্তাহাবকে ধরে রাখা এবং রাসুলের (সাঃ) প্রদত্ত সুযোগকে দুটি নামাজ একত্রে আদায় এড়িয়ে চলার কারণে অনেক সাধারণ লোক বিশেষতঃ যুবসমাজ নামাজের ন্যায় অপরিহার্য ইবাদতের প্রতি অনাগ্রহী হয়ে পড়ে । ফলে এহেন শোচনীয় অবস্থার দায়-দায়িত্ব উক্ত সুযোগ ব্যবহারের বিরোধিদের উপর বর্তাবে । তাই কোন মুস্তাহাব বিষয়কে ধরে রাখার জন্য ওয়াজীব বিধানের পরিত্যাগ আদৌ সঠিক নয় ।
মূল - আয়াতুল্লাহ মাকারেম শিরাজি ।
বাংলা অনুবাদ - মোহাম্মাদ মিজানুর রহমান ।
এছাড়া একত্রে আদায় করলে সাধারনত কোন নামাজই কাযা হওয়ার সম্ভবনা একেবারেই থাকে না । তাছাড়া একত্রে আদায় করলে প্রাত্যাহিক কাজেও অনেক সুবিধা পাওয়া যায় । মোটকথা একত্রে আদায়ের সুবিধা সকল দিক থেকেই বিদ্যমান । এবং এই সুযোগ স্বয়ং মহানবী (সাঃ) নিজে পালন করে আমাদের দান করে গেছেন ।
শীয়া মাযহাবের অনুসারীগন এই সুবিধার সদ্বব্যবহার করে থাকেন ।
লেখাটি সংগৃহীত এবং সংকলিত ।